October 30, 2024, 4:19 pm
নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার আশুলিয়ায় উত্তর ভাদাইলে সৎ ছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা করে নিজেদের ফ্লাটে ভাড়াটে খুনি ও সন্তানের হাতে স্বামী ও চার বছরের কন্যা সহ হত্যার শিকার হন স্ত্রী স্বপ্না বেগম। তারা হলেন-ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চু (৫৩), তার ৪র্থ স্ত্রী স্বপ্না বেগম (২৮) ও মেয়ে জান্নাতুল (৪)। হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন সহ জড়িত আসামী ১। তরিকুল ইসলাম @ তারেক @ হৃদয় (২৮) এবং ২। তানভীর হাসান হিমেল (২২) দ্বয়কে গ্রেফতার করেছে পিবিআই ঢাকা জেলা।
ভিকটিমগণ তাদের নিজেদের ৪তলা ভবনের ৪র্থ তলার ফ্লাটে বসবাস করতেন। একই ফ্লাটের অন্য রুমে ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চুর পূর্ব পরিচিত তরিকুল ইসলাম @ তারেক @ হৃদয় (২৮) বসবাস করতেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রি. তারিখ সকাল অনুমান ১১:৩০ টায় ভিকটিমদের বেড রুম থেকে আগুনের ধোঁয়া দেখে ভিকটিম স্বপ্নার সৎ ছেলে হিমেল ও ভাড়াটিয়া তারেক’দ্বয় আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করলে বাসার অন্যান্য ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসে। তারা রুমের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে আগুন নেভায় এবং ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চু (৫৩), তার ৪র্থ স্ত্রী স্বপ্না বেগম (২৮) ও মেয়ে জান্নাতুল (৪) দের মৃতদেহ খাঁটের উপর শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। এই ঘটনায় ভিকটিম স্বপ্না বেগমের বোন মোছাঃ লাবন্য আক্তার (২৪) ভিকটিম স্বপ্নার সৎ ছেলে তানভীর হাসান হিমেল (২২) কে সাথে নিয়ে থানায় গিয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানার মামলা নং ৩৮, তারিখ-১৩/০৯/২০২৪ইং, ধারা-৩০২/৩৪ পেনাল কোড দায়ের করেন। মামলাটি পিবিআই এর সিডিউলভূক্ত হওয়ায় ঘটনার পর থেকেই পিবিআই ঢাকা জেলা মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গত ০৪ অক্টোবর ২০২৪ খ্রি. তারিখে মামলাটি স্ব-উদ্যোগে মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে।
পিবিআই প্রধান অ্যাডিশনাল আইজিপি (চলতি দায়িত্বে) জনাব মোস্তফা কামাল এর সঠিক তত্ত্বাবধান ও দিক নির্দেশনায় পুলিশ সুপার, পিবিআই ঢাকা জেলা জনাব মোঃ কুদরত-ই-খুদা এর সার্বিক সহযোগিতায় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিঃ) মোঃ আনোয়ার হোসেন মামলাটির তদন্ত শুরু করেন এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিঃ) মোঃ আনোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে পিবিআই ঢাকা জেলার চৌকস তদন্ত টিম হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আসামীদের সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। প্রযুক্তির সহায়তায় এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আসামীদের গ্রেফতার ও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আলামত উদ্ধারের লক্ষ্যে চাঁদপুর জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান পরিচালনা করে গত ০৪ অক্টোবর, ২০২৪ইং তারিখে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানাধীন বারুয়াখালী নামক স্থান হতে আসামী তরিকুল ইসলাম @ তারেক @ হৃদয় (২৮)’কে গ্রেফতার করা হয়। ০৪ (চার) দিনের পুলিশ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে আসামী তরিকুল ইসলাম ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে এবং তার দেওয়া তথ্য এবং দেখানো মতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আলামত হাতুড়ি, পুতুল এবং সিজার (কাঁচি) জব্দ তালিকা মোতাবেক জব্দ করা হয়। তার দেওয়া তথ্য দেওয়া তথ্য মতে ঘটনার সাথে জড়িত অপর আসামী ভিকটিম স্বপ্নার সৎ ছেলে আসামী তানভীর হাসান হিমেল (২২) কে গত ২৪ অক্টোবর, ২০২৪ইং তারিখে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামীদ্বয়কে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় অপরাধ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।
তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ এবং বিজ্ঞ আদালতে আসামীদ্বয়ের প্রদত্ত ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারার জবানবন্দি পর্যালোচনায় জানা যায় যে, অত্র মামলার আসামী তানভীর হাসান হিমেল (২২) ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চুর ১ম স্ত্রীর সন্তান। ১ম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পরে বাচ্চু আরো দুইটি বিয়ে করলেও তাদের সাথেও বাচ্চুর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরবর্তীতে তিনি ভিকটিম স্বপ্না বেগম (২৮) কে বিবাহ করেন। ভিকটিম স্বপ্না বেগম (২৮) এবং মিজানুর রহমান বাচ্চুর সংসারে ০৪ (চার) বছরের একটি কন্যা জান্নাতুল জন্ম গ্রহণ করে। ভিকটিম স্বপ্না বেগম এবং ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চুর সাথে গ্রেফতারকৃত আসামী তানভীর হাসান হিমেল (২২) এর পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। এরই মধ্যে আসামী তানভীর হাসান হিমেল এর সৎ মা ভিকটিম স্বপ্না বেগম এবং তার বাবা ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চু হিমেলকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যাকান্ডের দেড় মাস আগে গ্রেফতারকৃত আসামী তরিকুল ইসলাম @ তারেক @ হৃদয় (২৮) কে ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চু (৫৩) তার বাসায় নিয়ে আসেন এবং তার ফ্ল্যাটের অপর একটি রুমে থাকতে দেন এবং তাদের সাথেই আসামী তরিকুলের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করেন। ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চু, ভিকটিম স্বপ্না বেগম এবং আসামী তরিকুল ইসলাম @ তারেক @ হৃদয় মিলে হিমেলকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ঘটনার ১০/১২ দিন আগে হিমেল বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে বাসায় ফিরে তার বাবা, সৎ মা এবং তারেক মিলে যে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে, বিষয়টি সে গোপনে শুনে ফেলে। পরবর্তীতে আসামী হিমেল, আসামী তরিকুল ইসলাম এর কাছে গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানতে চায়। একপর্যায়ে আসামী তরিকুল ইসলাম তাকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি তার কাছে স্বীকার করে। পরবর্তীতে আসামী হিমেল, আসামী তরিকুল ইসলাম এর কাছে অনেক কান্নাকাটি করে তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। তখন আসামী হিমেল এবং আসামী তরিকুল ইসলাম মিলে হিমেলের বাবা বাচ্চু এবং সৎ মা স্বপ্না বেগমকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
ঘটনার দিন অর্থাৎ গত ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ইং সকাল ০৮:০০ ঘটিকার সময়ে ভিকটিম স্বপ্না বেগম (২৮) মেয়ে জান্নাতুল (০৪) কে নিয়ে স্কুলে চলে যায়। এ সময় ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চু তার শয়নকক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন। সকাল অনুমান ০৮:৪৫ ঘটিকার সময়ে আসামী তরিকুল ইসলাম @ তারেক @ হৃদয় এবং আসামী তানভীর হাসান হিমেল ভিকটিম বাচ্চু’র শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। আসামী হিমেল তার হাতে থাকা হাতুড়ী দিয়ে ভিকটিম বাচ্চু’র মাথায় পরপর দুইটি আঘাত করে এবং আসামী তারেক ভিকটিম বাচ্চুর পা চেপে ধরে রাখে। পরবর্তীতে আসামী তারেক বালিশ চাপা দিয়ে ডিসিস্টের মৃত্যু নিশ্চিত করে ডিসিস্টের লাশ খাটের উপরে কাথা দিয়ে ডেকে রেখে আসামীরা ভিকটিম স্বপ্না বেগম এবং জান্নাতুল এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। অতঃপর সকাল অনুমান ১০:১০ মিনিটের সময় ভিকটিম স্বপ্না বেগম মেয়ে জান্নাতুলকে নিয়ে বাসায় এসে কলিং বেল চাপ দিলে হিমেল ভিতর থেকে দরজা খুলে দেয়। ভিকটিম স্বপ্না বেগম শয়নকক্ষে প্রবেশ করে বাচ্চুকে ডাকতে থাকে তখন আসামী তারেক পিছন থেকে ভিকটিম স্বপ্না বেগমের গলা চেপে ধরে বিছানার উপরে ফেলে বালিশ চাপা দিয়ে তাকে হত্যা করে। এ সময়ে ভিকটিম জান্নাতুল চিৎকার করে উঠলে আসামী হিমেল তাকে মেঝেতে ফেলে মুখ চেপে ধরে এবং পাশেই থাকা খেলনা পুতুল দিয়ে শাসরোধ করে হত্যা করে। পরবর্তীতে আসামীরা লাশ তিনটিকে খাটের উপরে পাশাপাশি শুইয়ে বিছানার চাদর দিয়ে ডেকে রাখে।
আসামীরা আলমারীতে থাকা স্বর্নালংকার লুট করে। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসামীরা রুমের ভিতরে কেরোসিন তেল দিয়ে আগুন লাগিয়ে সিজার (কাঁচি) দিয়ে লোহার সীটের দরজা ছিদ্র করে বাইরে থেকে দরজার ভিতরের হ্যাজভোল্ট লাগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে আগুনের ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আসামীরা আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করে। আসামীদের চিৎকার শুনে এবং আগুনের ধোঁয়া দেখে বাসার অন্যান্য ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় লোকজন আগাইয়া আসলে তাদের সহায়তায় রুমের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে আগুন নেভায় এবং ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চু, ভিকটিম স্বপ্না বেগম এবং ভিকটিম জান্নাতুল’দেরকে খাঁটের উপরে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। হত্যার পরে আসামীরা হত্যাকান্ডকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া এবং হত্যাকান্ডের প্রমাণ মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে কেরোসিন তেল দিয়ে আগুন লাগিয়ে কৌশলে রুমের দরজার বাইরে থেকে আটকে দেয়।